গণমাধ্যম হচ্ছে সেই মাধ্যম,যে মাধ্যমে সকল ধরনের মাধ্যম একীভূত থাকে,প্রযুক্তিগতভাবে গনযোগাযোগের যে কার্যক্রম তা এতে বহমান থাকে। যেমন- সম্প্রচার মাধ্যম (ইলেক্ট্রনিক) তার পাশাপাশি রয়েছে মুদ্রণে সংবাদপত্র,বিভিন্ন সাময়িকী, বই, লিফলেট। বর্তমানে মোবাইল বা সেলফোন,কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট। ইন্টারনেটকে নতুন-যুগের গণমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইন্টারনেট বর্তমান বিশ্বে অন্যতম গণমাধ্যম হিসেবে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছে।এ মাধ্যমে অনেক প্রকার সেবা-বিশেষ করে ই-মেইল, ওয়েব সাইট, ব্লগিং, ইন্টারনেট এবং টেলিভিশনের প্রচারকার্য ওএর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। গণ-মাধ্যম সমাজ জীবনের দর্পন হিসাবে ও কাজ করে যা আমাদের জীবনের ও সমাজের একটি অংশ হিসাবে বিবেচিত। বর্তমান সময়ে গণ-মাধ্যমের প্রভাব সর্বজন স্বীকৃত। যে পৃথিবীতে আমরা এখন বাস করছি তার এক একটা দিনের ইতিহাস হচ্ছে গণ-মাধ্যমগুলোর বিষয়বস্তু।আমাদের চলমান জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি কাজ, ছোট-ছোট ঘটনা গুলো প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত হয় এই গণ-মাধ্যমে। তাই জীবন ও সমাজের সাথে গণ-মাধ্যম একাকার হয়ে মিশে আছে। গণ-মাধ্যম একদিকে যেমন সমাজের চলমান চিত্র তুলে ধরে,তেমনি প্রচলিত ব্যবস্থাকে প্রতি- নিয়ত ভাঙছে,গড়ছে, ও সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করছে। গণ-মাধ্যমের একটি অঙ্গ সংবাদ পত্রের কথা যদি বলা হয় তাহলে বলতে হয়,সর্বপ্রথম সংবাদ প্রকাশ হয় জার্মানিতে ১৬০৯ সালে।এরপর ১৭০২সালে ডেইলি কুর্যান্ট’ নামে বৃটেনে এরপর ভারতীয় উপ মহাদেশে ১৭৮০ সালে-‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে (বাংলায়)।এরপর ১৮১৮ সালে ‘বাঙ্গাল গেজেট’।এরপর পূর্ব বঙ্গে ১৮৪৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় “রঙ্গপুর বার্তাবহ”। ১৮৯৪ সালে রেডিও, ১৯১৯ সালে চলচ্চিত্র, ১৯২৫ সালে টেলিভিশন আবিষ্কার হলে গণমাধ্যম জগতের এক অভাবনীয় বিপ্লব ঘটে। বাংলাদেশে প্রথম রেডিও সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৩৯ সালে আর টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৪ সালে।অনেকের মতে গণমাধ্যমে বেতার,টেলিভিশন, সংবাদ পত্র সহ যে সব অনুষঙ্গ রয়েছে তা সাধারনত তিন ধরণের হয়ে থাকে। প্রথমত,মুদ্রণ মাধ্যম যেমন সংবাদ পত্র, বই,ম্যাগাজিন। দ্বিতীয়ত, ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম যেমন -বেতার টিভি,চলচ্চিত্র তৃতীয়ত,নিউ মিডিয়া বা নতুন মাধ্যম’। তৃতীয়টি হচ্ছে গণমাধ্যমে নতুন ধারণা। তথ্য প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উন্নতির ফলে সৃষ্টি হয়েছে সক্রিয় ও কার্যকরী বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যম। যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি।এগুলোর বৈশিষ্ট্য ও ভূমিকা অনেকটা অন্যান্য গণমাধ্যমের মতোই। তাই এগুলোকে অনেকে বলছেন নিউ মিডিয়া। এর মধ্যে অনলাইন সংবাদপত্র অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।কেননা সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা পত্রিকা পড়ছি তাৎক্ষণিক সংবাদ পেতে রেডিও শুনছি, টিভি দেখছি।অবসরে বিনোদন পেতে আমরা অন্যান্য মাধ্যম ও ব্যবহার করছি। আমরা প্রধানত চারটি কাজে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করি তা হলো তথ্য জানার জন্য, কোনো বিষয়ে শিক্ষা নেয়ার জন্য, বিনোদন পেতে এবং প্রণোদিত হওয়ার জন্য। সারা বিশ্বে অধিকাংশ মানুষই কোনো না কোনো ভাবে গণমাধ্যম ব্যবহার করে।কারন সমাজ-সংস্কৃতি ও দেশের মানুষের প্রতি গণ-মাধ্যমের দায়িত্ব রয়েছে। গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে সঠিক ভাবে সবার সামনে তুলে ধরা যাতে মানুষ তার সমাজকে সঠিকভাবে জানতে পারে। আবার বিদ্যমান অসংগতিগুলো তুলে ধরাও গণমাধ্যমের দায়িত্ব। বর্তমানে মানুষ ও সমাজের ওপর গণমাধ্যমের প্রভাব এত বেশি যে গণমাধ্যম চাইলেই মানুষের কোনো বিষয় ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে পারে আবার নেতিবাচক ভাবেও দেখতে পারে।
কোন না কোন কারনে গণমাধ্যমের প্রচারণা ভুল হলে সমাজ,সংসার ও বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। গণমাধ্যমই একমাত্র মানুষের মধ্যে গণজাগরণ তুলতে পারে। আবার গণমাধ্যমের ভুল ও বিকৃত তথ্য সমাজে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। গণমাধ্যম একমাত্র মানুষের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করে। গণমাধ্যমকে এই জন্য বলা হয় গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে সুসংহত করে।পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। গণমাধ্যম মানুষকে মত প্রকাশের জায়গা তৈরি করে দেয়। যদিও গণমাধ্যমের নিজস্ব কর্মপদ্ধতি, নীতি ও বাকস্বাধীনতার অধিকার রয়েছে তবুও বেশির ভাগ সময়ই গণমাধ্যম ব্যবহৃত হয় শাসক শ্রেণির প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে। ধরা যাক্ বাংলাদেশ টেলিভিশনের কথা যে যে সময় ক্ষমতায় ছিল প্রতিটি সরকারই একে ব্যবহার করেছে নিজেদের রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে।কারন শাসকরা অন্যায়, অবিচার, শোষণ থেকে জনগণের চোখ ফেরাতে গণমাধ্যম গুলোকে ব্যবহার করে।নিজেদের গুণগান ও উন্নয়নের মিথ্যে ফিরিস্তি জনগনের নিকট তুলে ধরে।তবে যে যাই বলুক দেশের প্রকৃত উন্নয়নের কথা ভাবতে হলে প্রথমে ভাবতে হবে গণ মাধ্যমের কথা।গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়নের সাথে গণমাধ্যমের গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাহাছাড়া গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। আমরা জানি, একজন আত্মসচেতন ও বিবেকবান সংবাদকর্মী দেশ ও জাতির পথপ্রদর্শক। করন গণমাধ্যমই পারে মানুষকে নতুন,নতুন চিন্তা, ধারণা ও পদ্ধতি সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে।দুঃখজনক হলেও সত্য ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণেই আমাদের দেশে রাষ্ট্রের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গের পথচলা মোটেই সুখকর নয়। অপরাজনীতি ও ক্ষমতালিপ্সার কারণে বরাবরই আধুনিক রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।ফলে গণমাধ্যম কর্মীদের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে নানাবিধ অনিশ্চয়তা ও প্রতিকূলতা। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতা, বাধা-প্রতিবন্ধকতা আর সংকীর্ণতা সত্ত্বেও আমাদের দেশের সংবাদকর্মী ও গণমাধ্যম কর্মীদের ভূমিকা সত্যিই প্রশংনীয়।একজন সাংবাদিক বা গণ মাধ্যম কর্মী নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে রাতদিন জীবনের সোনালি সময় ব্যয় করে গণমানুষের সমস্যা ও সম্ভাবনার খোঁজে কান পেতে থাকেন। দিনের শেষে তার পাঠানো সংবাদ যখন পরদিন পত্রিকার পাতায় পাঠক হাতে পায় ও বাস্তবের প্রতিফলন ঘটে তখন হারানো সন্তান ফিরে পাওয়ার মতো তার ঐ গণ-মাধ্যমকর্মী আনন্দ অনুভব করে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে,যে যে সময় ক্ষমতা থাকে ঐ ক্ষমতাসীনরা সবসময়ই স্বাধীন গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে নেতিবাচক। কিন্তু এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না,গণমাধ্যম সব সময় সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত থাকে তা নয় অনেক সময় সুবিধা বাদী শ্রেণী সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে সরকারের একটি মহলকে হাত করে সুবিদা আদায়ে চেষ্টা করে পক্ষান্তরে রাষ্ট্রের ও জনগনের ক্ষতি করে সেই তথ্য সবার আগে গণমাধ্যম সরকারকে অবহিত করে সঠিক ভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় ও ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেয়। সরকারকে ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে আত্মসচেতন করে তুলে। আমরা জানি গঠনমূলক সমালোচনা সবসময় সরকারের জন্য ইতিবাচকই হয়ে থাকে। বর্তমান গণমাধ্যম জাতীয় উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখে তা আমাদের জাতীয় অর্জনের দিকে তাকালে সহজে অনুমেয়। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনে এই দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ন। গণমাধ্যম সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুর কাজ করে থাকে। গণমাধ্যম ছাড়া কোনোভাবেই জানা সম্ভব নয় তাহলো সরকার কি করছে,আর জনগন কি ভাবছে।আজ গণমাধ্যমের কল্যাণে পুরো পৃথিবী একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে।এর মাধ্যমে আমরা একে অন্যের জীবনযাত্রা আমাদের সুযোগ-সুবিধা সহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি। মূলত গণমাধ্যম জাতীয় উন্নয়ন, গণতন্ত্র,গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসনের জন্য অপরিহার্য। তাই গণমাধ্যম গুলোকে কে এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল গণ-মাধ্যম কর্মীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম কর্মীদের জীবন মান উন্নয়নে সরকার কে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে
—- মোঃ কামরুল ইসলাম
লেখক-[কবি,প্রাবন্ধিক,গণমাধ্যমকর্মী]